Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ছবি
শিরোনাম
আলী সুড়ঙ্গ
বিস্তারিত

আলোহক্যডং থেকে আলীকদম নামটির জন্ম। যার অর্থ পাহাড় আর নদীর মধ্যবর্তী স্থান। বান্দরবানের রাজা বোমাং সার্কেল চিফ এর নথিপত্রে ও পাকিস্তান আমলের মানচিত্রে আলোহক্যডং নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো মানচিত্রেও (Ensea Det Bengalla) পর্তুগীজ পণ্ডিত জোয়াও ডে বারোজ (Jao De Barros) আলোহক্যডং নামটি ব্যবহার করেছেন।

আরকানি ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামে ডং, থং বা দং উপসর্গ জুড়ে আছে। সম্ভবত: ডং মানেই পাহাড়। তাই ধারণা করা হয়, তাজিংডং ও কেউক্রাডং পাহাড়ের মতোই আলোহক্যডং একটি পাহাড়ের নাম, যা কালক্রমে আলীকদম নাম নিয়েছে।

অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টিএইচ লুইন এর মতে, ALLEY KINGDOM থেকে ALIKADAM নাম হয়েছে। তার মতে, ALLEY অর্থ দমন, আর KINGDOM অর্থ রাজ্য। বাংলায় মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এখানে ক্ষুদ্র এক রাজ্য শক্তিকে করায়ত্ব বা দমন করেন। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পাননি আমলে এ অঞ্চলের নাম হয় ALLEYKINGDOM বা দমন করা রাজ্য। যা পরবর্তীতে আলীকদম নামে টিকে থাকে।

নবম শতাব্দী থেকে আরাকানি শাসনে থাকা আলীকদম পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বাংলার সুলতান জালালউদ্দিনের করায়ত্ব হয়। ১৭৫৬ সালে মুঘলরা এ অঞ্চল জয় করলে আরাকানি শাসনের কফিন শেষ পেরেক ঠোকার কাজটি হয়ে যায়। আরাকান রাজ কং হ্লা প্রুকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে সপরিবারে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করা হয়। যদিও তারও অনেক আগে থেকে আলীকদমে শুরু হয় মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস।

আরকানি ইতিহাসে বলা হচ্ছে, শাসন পরিচালনার ফায়দা তুলছে ১৮ জন আরকানি রাজা মুসলিম উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে ১৪৩৪-১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন রাজা মাং খারি। তার মুসলিম উপধি ছিল ‘আলী খান’। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব পরিচালনাকারী রাজা থাজাথা’র মুসলিম উপাধি ছিল আলী শাহ্। এ দুই নামের প্রভাবে আলী কদম নামটি এসে থাকতে পারে।

অপর এক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, আরবীতে কদম অর্থ পা। প্রয়োগ ভেদে যার অর্থ পদাচারণাও হতে পারে। আলী নামের কেউ একজন কোনো এক সময় এ অঞ্চলে পা রেখে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার নামের সঙ্গে কদম শব্দটি যুক্ত হয়ে আলীকদম নামটির জন্ম।

তবে এমনও ধারণা প্রচলিত যে, হযরত শাহজালাল এর নেতৃত্বে ৩৬০ আউলিয়া ধর্মপ্রচারের জন্য সিলেট অঞ্চলে এলে তাদের একটি অংশ পার্বত্য এলাকায় আসেন, যাদের কারো নামের আলী উপাধি থেকে আলীকদম নামের জন্ম।

এই আলীকদমের অবস্থান বান্দরবান থেকে ১১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে। পাহাড়ের পর পাহাড়ে কোনো রাস্তা না থাকায় এতো দিন কক্সবাজারের চকোরিয়া ঘুরে দুর্গম এ উপজেলায় যেতে হতো। সম্প্রতি ডিম পাহাড়ের ওপর দিয়ে নির্মিত দেশের সবচেয়ে উঁচু রাস্তা দিয়ে এখানে যাওয়া যায়।

এ রাস্তার মাথায় পানবাজার এলাকা থেকে পূর্ব দিকে মাতামুহুরি নদীর তীরে আলীর পাহাড়ের অবস্থান। আলীকদম থেকে যার দূরত্ব ৪ কিলোমিটার মাত্র।

পার্বত্য আলীকদম উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলীকদম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ তার 'গিরিনন্দিনী আলীকদম' বইয়ে আলীর সুড়ঙ্গ নিয়ে একটি চমৎকার রূপকথা বলেছেন।

রুপকথাটি এই রকম : লোকালয় থেকে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী আলীর পাহাড়ে একদল মেহনতি কাঠুরিয়া জীবিকার সন্ধানে কাঠ, বাঁশ আহরণে যায়। প্রতিদিনের মতো পরিশ্রমি কাঠুরিয়ার দল নদীর ঢালুর পাড়ে নির্মিত এক চালা ঝুপড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সে সময় একজন ঝটাধারী লোক হঠাৎ তাদের সামনে আভির্ভূত হলে কাঠুরিয়াগণ ভীত-বিহ্বল হন। কাঠুরিয়ারা লোকটির প্রতি তেড়ে যায়। তখন লোকটি অপরাধীর ন্যায় করুণভাবে হাত জোড় করে বলে উঠে, আমাকে মেরো না। আমি কোনো জ্বিন, ভূত, পাগল বা দস্যু নই। আমি এক বিপন্ন, হতভাগ্য লোক। আমাকে আশ্রয় দাও। লোকটির করুণ মিনতিতে কাঠুরিয়াদের দয়া হলো। তাকে আশ্রয় দিয়ে তার আদ্যোপান্ত জানতে চাইলো।

তখন লোকটি তাদের কাছে যে কাহিনীটি বর্ণণা করলো তার সংক্ষিপ্তি রূপ এই: লোকটি বলল, সেই অনেকদিন আগে আমরা তোমাদের মতো একদল কাঠুরিয়া আলীর সুড়ঙ্গ সংলগ্ন স্থানে বাঁশ কাঠতে এসেছিলাম। একদিন সবাই গভীর অরণ্যে বাঁশ কাটতে যাই। এ সময় আমি সঙ্গীদের থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কোত্থেকে আদিম এক রূপসী কন্যা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার পরণে ছিল গাছের পত্রপল্লব। আমার সঙ্গী সাথীরা অনেক খোঁজাখুজির পর আমাকে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেলো। তারা মনে করলো, আমি কোন হিংস্র জীবজন্তুর শিকারে পরিণত হয়েছি। সঙ্গীদের খোঁজাখোঁজি আমি লক্ষ্য করলাম কিন্তু আওয়াজ করার মতো শক্তি তখন আমার ছিলনা।

পরে ঐ রূপসী কন্যা আমাকে নিয়ে আলীর সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লো। লোকটি আরো জানাল, আলীর পাহাড়ে সুড়ঙ্গ রয়েছে পর পর তিনটি। আমাকে নিয়ে ঐ রূপসী সুড়ঙ্গের তৃতীয়টিতে প্রবেশ করলো। সে থেকে আমি অন্ধকারে বন্ধি হলাম। আমার মনে হয় মহিলাটির উদ্দেশ্য ছিল আমাকে তার সঙ্গী করা। বাস্তবেও ঘটেছিল তাই। মাঝে মধ্যে ঐ রূপসী শ্বেতকায়ার বিশাল দেহী ইয়া লম্বা মহিলায় রূপ নিত। তার অবয়ব হয়ে যেত অদ্ভুত আকৃতির। তার পরণে থাকতো পশুর চামড়া। পাখির পলক ছাড়া কোনো অলংকার ছিলনা। আগুনের ব্যবহার জানতো না। পশু পাখির গোশত ও ফলমুল খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। ক্ষুধার জ্বালায় আমিও আস্তে আস্তে সে সব খেতে বাধ্য হলাম।

মহিলাটি আমকে সুড়ঙ্গে রেখে গহীন অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াতো। শিকারে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে গুহা মুখে একটি বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। যাতে আমি সুড়ঙ্গ থেকে কোনো মতেই বেড় হতে না পারি। দিন যায়, মাস যায় এভাবে বছর পার হয়। ক্রমান্বয়ে মহিলাটি আমার সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। কখন দিন রাত হয় গুহার মধ্য থেকে আমি কিছুই জানতে পারতাম না। তিমির সুড়ঙ্গের বন্দিজীবন আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠলো।

তারপর মহিলাটি তার মানস কামনা চরিতার্থ করতে আমাকে কাছে টানতে থাকে। আমিও তার ভয়ে সবকিছু করতে বাধ্য হতাম। এক পর্যায়ে আমাদের অভিসারের ফলে মহিলাটির গর্ভে সন্তান আসে। যথারীতি মহিলাটি একটি ফুটফুটে সন্তান প্রসব করে। ডাইনিটি তখন মনে করলো আমি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আদৌ তার প্রতি আমার আসক্তি ছিলনা। আমরা একে অপরের ভাষা বুঝতাম না। ইশারা ইঙ্গিতে আমাদের কথাবার্তা হতো।

একদিন ডাইনি শিকারে যাওয়ার সময় গুহামুখে পাথর চাপা দিয়ে যায়নি। এতে করে বাহির থেকে সূর্যের আলোর ঝলকানি ছিদ্র পথে গুহার ভিতর প্রবেশ করে। তখন আমি এই সুযোগটি গ্রহণ করি এবং গুহা থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে এসে এই মায়াময় পৃথিবীর আকাশ, হৃদয় দোলানো বাতাস আমার অস্তিত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। প্রকৃতির কোলাহল মনকে দোলা দিতে থাকে। সুন্দর পৃথিবীর অতীত স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে উঠে। ডাইনীর কথা মনে পড়তেই আমি সেখান থেকে এইতো পালিয়ে তোমাদের সামনে এলাম!

তাদের সেই পারস্পরিক আলাপচারিতার শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ডাইনী মহিলা তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। সকলে হতভম্ব ও দিকভ্রান্ত হলো। তখন ডাইনী রক্তচক্ষে পালিয়ে আসা লোকটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তর্জন গর্জন করতে থাকে। সেখানে দাড়িয়ে ডাইনী অনেক্ষণ অরণ্যরোদন করলো। তার সেই কান্নায় বিরহের সুর ফুটে উঠে। একপর্যায়ে তার আচরণে হিংস্ররতা প্রকাশ পায়। তখন দুর্বোধ্য ভাষায় কুলের শিশুকে কি যেনো বলতো চাইলো। অত:পর বাচ্চাটির দু‘পা ধরে টান দিয়ে আকস্মিক দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। এর এক খণ্ড তার প্রণয়ী লোকটির প্রতি নিক্ষেপ করলো অপর খণ্ড ডাইনী মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে গহীন অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সে হতে সভ্য জগতের কোনো লোকচক্ষুর সামনে ডাইনিটি দৃশ্যমান য়নি।